০৭:৫১ অপরাহ্ন, রবিবার, ০১ জুন ২০২৫, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নারায়ণগঞ্জ ৭ লাশের আর্তনাদ আজও শীতলক্ষ্যার জলে, ১১ বছরেও বিচার অপূর্ণ

  • Reporter Name
  • প্রকাশের সময়ঃ ০৩:৫১:৩২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৫
  • ১১৩ বার পড়া হয়েছে

স্টাফ রিপোর্ট  নারায়ণগঞ্জঃ নারায়ণগঞ্জের ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংস ৭ খুনের আজ ১১ বছর পূর্ণ হলো। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল অপহরণের পর শীতলক্ষ্যার বুকে ভেসে ওঠা সাতটি মরদেহ কাঁপিয়ে দিয়েছিল গোটা দেশকে। বিচার শুরু হয়েছিল দ্রুত, তবে শেষ হয়নি এখনো। আপিল বিভাগের শুনানি ঝুলে থাকার কারণে আজও ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত নিহতদের পরিবার।

জেলা জজ আদালতে ৩৩ মাসের মধ্যে রায়, ১৯ মাসে হাইকোর্টে রায় হলেও সাড়ে ৭ বছরেও আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায় আসেনি। বিচারিক ধীরগতির জন্য নিহতদের পরিবার এবং নাগরিক সমাজ বর্তমান সরকারের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। তারা বলছে, প্রভাবশালীদের চাপেই আটকে আছে ন্যায়বিচার।

রক্তাক্ত দিন: সাত প্রাণের নির্মম অপহরণ

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল, আদালতে হাজিরা দিয়ে ফেরার সময় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের লামাপাড়া থেকে অপহৃত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, বিশিষ্ট আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন। তিনদিন পর, শীতলক্ষ্যা নদীর শান্তিরচরে মিলেছিল তাদের গুলিবিদ্ধ ও নির্যাতনের চিহ্নযুক্ত মরদেহ। দেশজুড়ে নেমে আসে শোক আর ক্ষোভের সুনামি।

দ্রুত শুরু, ধীরগতির শেষপ্রান্ত

ঘটনার পর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ও চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল পৃথক দুটি হত্যা মামলা করেন। তদন্তে উঠে আসে ভয়াবহ তথ্য—অভিযুক্তদের মধ্যে ছিল স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা ও নিরাপত্তা বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি জেলা ও দায়রা জজ আদালত ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন। পরে ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট হাইকোর্ট ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। তবে আপিল বিভাগে এখনো ঝুলে আছে চূড়ান্ত রায়।

পরিবারের কান্না থামেনি

নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বলেন, আমার সন্তানরা আজও বাবাকে খোঁজে। ১১ বছরেও বিচার হয়নি। আমরা নতুন সরকারের কাছে দ্রুত বিচার ও রায় কার্যকরের দাবি জানাই।

নিহত তাজুল ইসলামের বাবা মো. আবুল খায়ের বলেন, নতুন সরকার এসেছে। নতুন অ্যাটর্নি জেনারেল, প্রধান বিচারপতির প্রতি আকুল আবেদন—আমার ছেলের হত্যার বিচার যেন দ্রুত শেষ হয়।

নিহত গাড়িচালক জাহাঙ্গীরের মা মেহরুন বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ছেলেকে তো আর ফিরে পাবো না, অন্তত হত্যাকারীদের বিচার দেখে মরতে চাই।

তার স্ত্রী নুরুন্নাহার নুপুর বলেন, ছোট মেয়ে বাবাকে নিয়ে প্রতিদিন প্রশ্ন করে। একা হাতে সংসার টেনে চলেছি। আমি বিচার চাই, অবিলম্বে।

বিচার বিলম্বে ক্ষোভ

নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের সহকর্মী এডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, রায় কার্যকর হলে দেশ থেকে গুম-খুনের সংস্কৃতি বন্ধ হতে পারত। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় বিচার দীর্ঘসূত্রতায় পড়েছে।

বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন ঢাকা বিভাগের সমন্বয়ক এডভোকেট মাহবুবুর রহমান মাসুম বলেন, সাজাপ্রাপ্তরা ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় আপিলের রায় সুরাহা হয়নি। এখন সরকারের বদল হয়েছে, আমরা আশা করি বিচার হবে দ্রুত।

নারায়ণগঞ্জবাসীর আহ্বান: ন্যায়বিচার দিন

নারায়ণগঞ্জ নাগরিক সমাজ এবং সাধারণ মানুষ মনে করেন, ৭ খুনের দ্রুত বিচার এবং ফাঁসি কার্যকর হলে এটা হবে ইতিহাসে অপরাধীদের জন্য একটি বড় দৃষ্টান্ত। এই রায় বাস্তবায়িত না হলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে না, বরং প্রভাবশালীদের অপরাধ প্রবণতা আরও বেড়ে যাবে।

Tag :
About Author Information

রূপগঞ্জ টানা বর্ষণে ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি, স্থায়ী জলাবদ্ধতা

নারায়ণগঞ্জ ৭ লাশের আর্তনাদ আজও শীতলক্ষ্যার জলে, ১১ বছরেও বিচার অপূর্ণ

প্রকাশের সময়ঃ ০৩:৫১:৩২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৫

স্টাফ রিপোর্ট  নারায়ণগঞ্জঃ নারায়ণগঞ্জের ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংস ৭ খুনের আজ ১১ বছর পূর্ণ হলো। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল অপহরণের পর শীতলক্ষ্যার বুকে ভেসে ওঠা সাতটি মরদেহ কাঁপিয়ে দিয়েছিল গোটা দেশকে। বিচার শুরু হয়েছিল দ্রুত, তবে শেষ হয়নি এখনো। আপিল বিভাগের শুনানি ঝুলে থাকার কারণে আজও ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত নিহতদের পরিবার।

জেলা জজ আদালতে ৩৩ মাসের মধ্যে রায়, ১৯ মাসে হাইকোর্টে রায় হলেও সাড়ে ৭ বছরেও আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায় আসেনি। বিচারিক ধীরগতির জন্য নিহতদের পরিবার এবং নাগরিক সমাজ বর্তমান সরকারের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। তারা বলছে, প্রভাবশালীদের চাপেই আটকে আছে ন্যায়বিচার।

রক্তাক্ত দিন: সাত প্রাণের নির্মম অপহরণ

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল, আদালতে হাজিরা দিয়ে ফেরার সময় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের লামাপাড়া থেকে অপহৃত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, বিশিষ্ট আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন। তিনদিন পর, শীতলক্ষ্যা নদীর শান্তিরচরে মিলেছিল তাদের গুলিবিদ্ধ ও নির্যাতনের চিহ্নযুক্ত মরদেহ। দেশজুড়ে নেমে আসে শোক আর ক্ষোভের সুনামি।

দ্রুত শুরু, ধীরগতির শেষপ্রান্ত

ঘটনার পর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ও চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল পৃথক দুটি হত্যা মামলা করেন। তদন্তে উঠে আসে ভয়াবহ তথ্য—অভিযুক্তদের মধ্যে ছিল স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা ও নিরাপত্তা বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি জেলা ও দায়রা জজ আদালত ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন। পরে ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট হাইকোর্ট ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। তবে আপিল বিভাগে এখনো ঝুলে আছে চূড়ান্ত রায়।

পরিবারের কান্না থামেনি

নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বলেন, আমার সন্তানরা আজও বাবাকে খোঁজে। ১১ বছরেও বিচার হয়নি। আমরা নতুন সরকারের কাছে দ্রুত বিচার ও রায় কার্যকরের দাবি জানাই।

নিহত তাজুল ইসলামের বাবা মো. আবুল খায়ের বলেন, নতুন সরকার এসেছে। নতুন অ্যাটর্নি জেনারেল, প্রধান বিচারপতির প্রতি আকুল আবেদন—আমার ছেলের হত্যার বিচার যেন দ্রুত শেষ হয়।

নিহত গাড়িচালক জাহাঙ্গীরের মা মেহরুন বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ছেলেকে তো আর ফিরে পাবো না, অন্তত হত্যাকারীদের বিচার দেখে মরতে চাই।

তার স্ত্রী নুরুন্নাহার নুপুর বলেন, ছোট মেয়ে বাবাকে নিয়ে প্রতিদিন প্রশ্ন করে। একা হাতে সংসার টেনে চলেছি। আমি বিচার চাই, অবিলম্বে।

বিচার বিলম্বে ক্ষোভ

নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের সহকর্মী এডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, রায় কার্যকর হলে দেশ থেকে গুম-খুনের সংস্কৃতি বন্ধ হতে পারত। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় বিচার দীর্ঘসূত্রতায় পড়েছে।

বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন ঢাকা বিভাগের সমন্বয়ক এডভোকেট মাহবুবুর রহমান মাসুম বলেন, সাজাপ্রাপ্তরা ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় আপিলের রায় সুরাহা হয়নি। এখন সরকারের বদল হয়েছে, আমরা আশা করি বিচার হবে দ্রুত।

নারায়ণগঞ্জবাসীর আহ্বান: ন্যায়বিচার দিন

নারায়ণগঞ্জ নাগরিক সমাজ এবং সাধারণ মানুষ মনে করেন, ৭ খুনের দ্রুত বিচার এবং ফাঁসি কার্যকর হলে এটা হবে ইতিহাসে অপরাধীদের জন্য একটি বড় দৃষ্টান্ত। এই রায় বাস্তবায়িত না হলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে না, বরং প্রভাবশালীদের অপরাধ প্রবণতা আরও বেড়ে যাবে।