সকালে ঘুম থেকে ওঠে কাজে বের হওয়ার সময় দেখলাম সত্তর পচাত্তর বছর বয়স্ক পাঞ্জাবি পরিহিত এক ব্যক্তি চালের থলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের বারান্দার সিঁড়ির নিচে। দেখে খুব মায়া লাগলো। শুধু জিজ্ঞেস করলাম বাড়ি কোথায়।
তারপর ভাতিজিকে ডেকে চাল দিতে বললাম। কোনো বয়স্ক মানুষকে সহায়তা চাইতে বা ভিক্ষা করতে দেখলে সত্যি আমি খুব মর্মাহত হই।
বাজারে ঢুকতেই আর একজন বয়স্ক লোককে একটি চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দাঁড়ালাম। হাতে একটা লাঠি এবং পুরাতন একটা শপিং ব্যাগ। সাদা মলিন পাঞ্জাবি এবং পায়জামা পরিহিত। লোকটি আমার পূর্ব পরিচিত তাই তাকে দেখে দাঁড়ালাম।
পেছন থেকে পিঠে হাত রাখলাম। আমার দিকে ফিরে তাকালেন। তারপর জিজ্ঞেস করলাম কেমন আছেন এবং কোথায় যাচ্ছেন।
বয়স্ক ব্যক্তিটি একসময় হাটে হাটে টেবিল পেতে ক্ষতিকর প্রাণী নাশক ঔষধ বিক্রয় করতেন। ধর্মপাশা,নৈহাটি,ছেচরাখালি,মোহনগঞ্জ,বাদশাহগঞ্জ,
বারহাট্টা বাজারে হাটের দিন এই ঔষধগুলো বিক্রয় করতেন। পাশাপাশি বিবাহের ঘটকালিও করতেন। ঘটকালি সূত্রেই আমার সাথে পরিচয় ছিলো। আমাদের বাড়িতেও এনেছি দুএকবার। কয়েক বছর যাবত দেখা নেই, যোগাযোগও নেই। এরই মধ্যে তার এমন শারীরিক দুরবস্থা। হাঁটারও তেমন শক্তি নেই।
তার সাথে কথা বলে আমি স্কুলের দিকে রওয়ানা হলাম। একটু এগিয়ে পেছন ফিরে তাকালাম। তাকে দেখে মনে হলো লোকজনের কাছ থেকে সাহায্য উঠাচ্ছেন। আমি একটু পিছিয়ে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম আপনি কি সাহায্য উঠাচ্ছেন। তিনি বললেন কাজ করার শক্তি নেই। তাই সাহায্য উঠিয়েই চলতে হয়। আমি তার হাতে একটি একশো টাকার নোট ধরিয়ে চলে গেলাম। যে লোকটা হাটের পর হাট দাবিয়ে চলতো সে আজ পথের ফকির।
কতো মানুষ আমাদের আশেপাশে কতো অসহায় অবস্থায় আছে তার ইয়ত্তা নেই।
মাসখানেক আগে আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রামের এক হিন্দু দাদা বাড়ির বাইরে থেকে আমায় ডাকছেন। তারপর ডেকে ঘরে এনে বসালাম এবং চা বিস্কিটের ব্যবস্থা করলাম। তিনি আমাদের বিদ্যালয়ের সিনিয়র ভাই ছিলেন। তিন চার বছর আগে স্ট্রোক করে কাজ করার শক্তি হারিয়েছেন। ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা করার খরচ চালাতে পারছেন না। ঘরে খাবারের ব্যবস্থা করতে পারছেন না। কেউ একজন বলে দিয়েছেন আমার কাছে এলে আমি কিছু সাহায্যের ব্যবস্থা করে দিতে পারবো। আমি তাকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম আসলে কাউকে সাহায্য করার মতো আমার কোনো সামর্থ্য নেই। মাঝে মাঝে অন্য কারোর মাধ্যমে মানুষের কাছ থেকে হাত পেতে নিয়ে কোনো অসহায় মানুষকে সাহায্য করে থাকি। তারপর তাকে সরকারি কিছু সুবিধা পাওয়ার কিছু তথ্য ও পরামর্শ দিয়ে বিদায় করি।
মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। ভাবি আমার ক্ষেত্রেও তো এমনটা হতে পারে।
আমার এক প্রতিবেশী বড় ভাই সিকেপির ৮৬ ব্যাচের ছাত্র ছিলো। বিএ পাশ করেও কিছু করতে পারে নি। এক শারীরিক প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে নিদারুণ কষ্টে সংসার চালায়। কোনো ধরনের আয় রোজকার নেই। খুব সামান্য কিছু জমি আছে। এতে কোনো অবস্থাতেই চলে না। দেখলেই খুব মায়া লাগে। মনে হয় এগিয়ে গিয়ে কিছু সহযোগিতা করি। কিন্তু আমার কী সেই সামর্থ্য আছে! কদিন যাবত আমায় বিরক্ত করছে তার কিছু প্রবাসী এবং সামর্থ্যবান বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিতে। আমি একজনের নম্বর সংগ্রহ করে দিয়েছি। আমার আশেপাশে এমন অনেক পরিবার রয়েছে যাদের অবস্থা দেখলে খুবই মায়া লাগে।
আমি কারো খাবারের কষ্ট সইতে পারি না। কেউ খাবার চাইতে বা খাবারের জন্য সাহায্য চাইতে এলে আমার চোখে জল আসে। কিন্তু অনেক মানুষ আমার নিকট তাদের নানান সমস্যা নিয়ে আসে। অথচ আমি নিজেই নানান সমস্যার বলয়ে আবদ্ধ।
আমি নিজেই তো ঠিকমতো আমাদের পরিবারের প্রয়োজনীয় খাবার যোগান দিতে পারি না। আমার মতো আরো অনেকেই এমন আছে। কিন্তু লজ্জায় বলতে পারে না কেউ। রাজনৈতিক যাঁতাকলে পড়ে আমাদের মতো একটা শ্রেণী দিনে দিনে দারিদ্র্যের দুষ্ট চক্রে হারিয়ে যাচ্ছে।
এখান থেকে পরিত্রাণের আর কোনো উপায় নেই বলেই মনে হয়।
সকল অবমানিতের এবং দারিদ্র্যের দুষ্ট চক্রে পতিত মানুষদের জন্য শুভ কামনা রইলো।
সমাজের সমৃদ্ধশালী মানুষদের প্রতি বিনীত অনুরোধ থাকবে যার যার অসহায় প্রতিবেশীর প্রতি একটু খেয়াল রাখুন এবং তাদের প্রয়োজনমতো সহায়তা দিন।
নিশ্চয়ই এতে আপনার সম্পদের কোনো কমতি হবে না।
—————-
.