নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রতিনিধিঃ আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করছে বর্তমান খালি মাঠে থাকা বিএনপি। বিএনপির সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রত্যাশীরা নির্বাচনী এলাকায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। সেই সাথে তারা নিজেদের পথ পরিস্কারে নানাভাবে কূটকৌশল করে যাচ্ছেন। তারই অংশ হিসেবে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন এলাকায় আলোচনায় থাকা জেলা বিএনপির সভাপতি মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিনের বিরোধী পক্ষ ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করেছেন। তারা সকলে মিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিনকে আটকানোর চেষ্টায় রয়েছেন। এর মধ্যে আবার পলাতক এমপি শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ অনুসারীদেরও দেখা যাচ্ছে। এছাড়া এ প্রচেষ্টাতে আছেন দলচ্যুত কয়েকজনও। বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা নেতারাও শামিল হয়েছেন এ দলে।
সূত্র বলছে, দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিলো দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। আর এই দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকাবস্থায় বিএনপির তৃণমূল থেকে শুরু শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত নানাভাবে নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। বিএনপির নেতাকর্মীদের বহুদিন বাড়ি-ঘর ও পরিবার পরিজন ছেড়ে দিন যাপন করতে হয়েছে।
এরই মধ্যে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে। সেই সাথে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা দেশে ছেড়ে অন্য দেশে পাড়িয়ে জমিয়েছেন। আর এই অবস্থায় দেশে আবারও নতুন করে সংসদ নির্বাচনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সেই সাথে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ সংসদ নির্বাচনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
আর এই অবস্থায় অন্যান্য আসনের মতো নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন এলাকাতেও বিএনপির সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রত্যাশীরা সরব হয়েছেন। তারা বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে নিজেদের জানান দিয়েছেন।
ইতোমধ্যে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মামুন মাহমুদ ও ফতুল্লা থানা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াদ চৌধুরী সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে জানান দিয়েছেন। সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এ মামুন মাহমুদকে বিগত দিনে ভদ্রলোক হিসেবে বার বার আখ্যা দিতেন শামীম ওসমান। কথিত আছে তিনি নিজেও শামীম ওসমানের সঙ্গে নানা মাধ্যমে যোগাযোগ রাখতেন।
তবে তাদের বাইরেও অনেকেই নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। সময়মতো সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে আবির্ভাব হবেন। আর এসকল সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে সকলেরই টার্গেট হবেন মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন। তারা সকলেই গিয়াসকে আটনানোর চেষ্টা করে যাবেন। আর এই আটকাতে গিয়ে গিয়াসের বিরোধী সকল সম্ভাব্য প্রার্থীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাবেন গিয়াসের বিরুদ্ধে। নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে তাদের সেই বলয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
বিএনপির একাধিক সূত্র জানান, বিএনপির একটি গ্রুপ গিয়াসউদ্দিনকে সরাতে উঠেপড়ে লেগেছে প্রতিপক্ষ গ্রুপ। তারা এবার মাঠে নামিয়েছে মনির কাশেমীকে। এরই মধ্যে নির্বাচনকে সামনে রেখে জেলা বিএনপির সভাপতি গিয়াসউদ্দিনের প্রতিপক্ষ হিসেবে হেফাজতের ইসলামের নেতা মনির হোসাইন কাশেমী মাঠে নেমেছেন। ২৫ অক্টোবর ফতুল্লা প্রেস ক্লাবের আয়োজনে ফুটবল টুর্নামেন্টে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তিনি। সেই খেলার অন্যতম আয়োজক ছিলেন ফতুল্লা থানা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াদ মোহাম্মদ চৌধুরী। এছাড়াও ছিলেন থানা বিএনপির সভাপতি শহীদুল ইসলাম টিটু প্রমুখ। এছাড়াও যারা ছিলেন সকলেই মূলত গিয়াসউদ্দিন বিরোধী হিসেবে পরিচিত।
এ টিটুর বিরুদ্ধেও আছে নানা অভিযোগ। ফতুল্লা থানা বিএনপির সেক্রেটারী অ্যাডভোকেট বারী ভূইয়ার অভিযোগ, গত কয়েক মাসে টিটু কোটি টাকার চাঁদাবাজীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। কোন ব্যবসা বাণিজ্য না করে কোটিপতি বনে গেছেন এ নেতা।
বিএনপির একাধিক সূত্র জানান, রাজধানীর দিলকুশা, ফতুল্লার একটি কারখানা ও সবশেষ রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে দফায় দফায় বৈঠকগুলো হচ্ছে। সেখানে ইসলামী দলের একজন নেতা, ফতুল্লার বিএনপির সাবেক একজন ও বর্তমান কমিটির একজন তরুণ নেতা, সিদ্ধিরগঞ্জের একজন নেতা, রূপগঞ্জের একজন বিএনপি নেতা ও আড়াইহাজারের একজন ছিলেন। এছাড়া কিছু সভায় তাদের অনুসারীরাও ছিলেন।
সভাগুলোতে মূলত নির্বাচন টার্গেট করে জেলা বিএনপির কমিটি ভেঙে দেওয়া ও গিয়াসউদ্দিনকে রুখে দেওয়ার বিষয়টি আলোচনায় আনা হয়। সভায় উঠে আসে, এ সময়ে গিয়াসউদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক খোকন বেশ শক্ত অবস্থানে আছেন। তারা সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি করেছেন। ফলে ৩ বছরের আগে কমিটি ভাঙার সুযোগ কম। তাছাড়া ইতোমধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের তালিকাও কেন্দ্রে জমা আছে।
সভায় বলা হয়, গিয়াসউদ্দিনকে দুই কারণে সরাতে হবে। প্রথমত তার নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে হবে। কারণ শামীম ওসমানের সঙ্গে তিনি জিতেছিলেন। তাকে সরানো না গেলে একটি গ্রুপের পছন্দের প্রার্থীকে দাঁড় করানো যাবে না। সে ক্ষেত্রে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে আগে নির্বাচন করা জমিয়তের নেতা মনির হোসাইন কাশেমীকে টার্গেট করছেন বিএনপির কতিপয় নেতা। মনির কাশেমীকে দিয়ে গিয়াসউদ্দিনকে ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। পরবর্তীতে আগ্রহী হলে পদত্যাগী বিএনপি নেতা শাহআলমকেও সামনে আনার চেষ্টা করা হবে।
তাছাড়া গিয়াসউদ্দিনকে সরানো না গেলে থানা কমিটি কিংবা জেলায় প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব হবে না উঠে আসে আলোচনায়। এজন্য যে কোন মূল্যে কমিটি পুনর্গঠনের কথা বলা হয়।
সভায় বলা হয়, জেলা ও মহানগর ছাত্রদলের কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এ দুটি কমিটি যে কোন মূল্যে নিজেদের কব্জায় আনতে হবে। জেলা যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মহানগর যুবদলের কমিটিও পুনর্গঠনের কথা বলা হয়। সেখানে একজন কেন্দ্রীয় নেতা আশ^স্ত করেন কমপক্ষে ৩ কোটি টাকা হলে এসব কমিটি রদবদল বা পুনর্গঠন সম্ভব। বিষয়টি নিয়ে ফতুল্লার একজন শিল্পপতি ও রূপগঞ্জের ব্যবসায়ী নেতাকে চিন্তা করার কথা বলা হয়েছে। এ দুইজন টাকার যোগান দিলে ওই কেন্দ্রীয় নেতা কেন্দ্রে দৌড়ঝাঁপ করবেন আসস্থ করেছেন।
রূপগঞ্জের নেতা গোলাম ফারুক খোকন জেলা বিএনপির সেক্রেটারী। তাকে নিয়েও অস্বস্তি একটি অংশের নেতাদের। তারা মনে করেন যে কোন উপায়ে খোকনকে সরানো গেলে পুরো জেলা বিএনপির কমিটি তাদের নিয়ন্ত্রনে আসবে। তখন জেলা বিএনপি মূলত সহযোগি সংগঠনের কমিটি গঠনে জোরালো সুপারিশ করতে পারবে। আর যেহেতু সামনে নির্বাচন সেহেতু পদধারী নেতারা যার পক্ষে থাকবেন তার পাল্লাই ভারী হবে বেশী।
৫ আগস্টের পর শামীম ওসমান দেশত্যাগ করেন। বদলে যায় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। এ কারণেই নির্বাচনকে ঘিরে কৌশলে আগাতে চান মনির কাশেমী। তিনি এখানে কয়েকটি ইস্যু সামনে এনেছেন। প্রথমত বিএনপির একটি অংশকে আয়ত্বে নেওয়া। এরই মধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার একটি আগামীতে জেলা বিএনপির সভাপতি গিয়াসউদ্দিনকে রুখে দিতে মাঠে থাকবে একটি গ্রুপ। এর মধ্যে গিয়াসের তুমুল বিরোধী হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ আলী। ২০০১ সালের নির্বাচনে ভোটের মাত্র কয়েকদিন আগে কৃষক লীগ থেকে গিয়াসউদ্দিনকে বিএনপিতে যোগদান করিয়ে ধানের শীষ প্রতীকের মনোনয়ন বাগিয়ে এনে দেন মোহাম্মদ আলী। পরবর্তীতে তাদের সম্পর্ক ভালো যায়নি। এ কারণে আগামী নির্বাচনে গিয়াসকে ঠেকাতে মোহাম্মদ আলী মাঠে থাকবেন এমন আশায় তাকে ম্যানেজের অংশ হিসেবে ফেরদাউসকে কাছে টেনে নিয়েছেন মনির কাশেমী। কারণ মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে ফেরদাউসের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। এছাড়া শামীম ওসমান ও তার অনুসারীদের সঙ্গেও আছে ফেরদাউসের সু সম্পর্ক। রাজনৈতিক বৈরিতার কারণে গিয়াসউদ্দিনের সঙ্গে শামীম ওসমানের সম্পর্ক ছিল দা কুমড়ার। বিগত কয়েক বছরে গিয়াসউদ্দিনের উপর অত্যাচার, মামলার পেছনে কলকাঠি নাড়েন শামীম ওসমান। মঞ্চে উঠে গিয়াসের বিরুদ্ধে ভর্ৎসনা ও হুমকিমূলক বক্তব্যও দেন শামীম ওসমান। ফলে এ বিষয়টিকেও কাজে লাগাতে ফেরদাউসকে ব্যবহার করবেন কাশেমী। এছাড়া গিয়াসের বিরোধী হিসেবে খ্যাত জেলা বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব মামুন মাহমুদ ইস্যুও আছে সামনে। এ মামুন মাহমুদের সঙ্গেও ফেরদাউসের সুসম্পর্ক। মূলত গিয়াস বিরোধী সব দলের নেতাদের জোটকে কাজে লাগিয়ে একটি বৃহৎ আকারে রূপ নিতে ফেরদাউসকে এবার কাছে টেনে নিচ্ছেন মনির হোসাইন কাশেমী। এ কারণেই কেন্দ্রীয় নির্দেশনাকে অমান্য করে নিজেই জেলার সভাপতি হতে চেয়েছেন। ফেরদাউসের বিরুদ্ধে বিতর্ক থাকায় তাকে সহ সভাপতি ও পুরো কমিটিতে তার লোকজনদের আধিক্য রাখা হয়।