আজ ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৮শে এপ্রিল, ২০২৫ ইং

শিবালয়ে আওয়ামী লীগের দোসর প্রধান শিক্ষকের দুর্নীতির তদন্ত করতে শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে অভিযোগ

মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি: মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার বাড়াদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহ মো. রফিকুল ইসলাম অ্যাডিশনের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা আত্নসাতের অভিযোগ তদন্তের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে পাঠানো হয়েছে। শিক্ষার্থী-অভিভাবক, এলাকাবাসী ও ভূক্তভোগিদের লিখিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শিবালয় উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মো. বেলাল হোসেন অভিযোগপত্রটি পাঠিয়েছেন। এদিকে, অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক বিষয়টি ম্যানেজ ও ধামাচাপা দিতে নানাভাবে অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন অভিযোগকারীরা।

স্থানীয়রা ও ভূক্তভোগিরা অভিযোগ করে জানান, ১৯৯৯ সালে প্রধান শিক্ষক যোগদান করেন। এরপর থেকেই তিনি নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ২০০৯ সালের পর থেকে ওই প্রধান শিক্ষক আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেন। উথলি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টার দায়িত্বপালন করেন। পছন্দ মতো প্রতিবার বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি গঠনেও তাঁর অপতৎরতা রয়েছে। তিনি লুটপাতে বৈধতার জন্য স্থানীয় প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে পকেট কমিটি গঠন করে হাতিয়ে নিতেন অর্থ। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সরকারি নির্ধারিত ফি’র চেয়ে অতিরিক্ত ভর্তি ফি, সেশন ফি বেতন ও পরীক্ষা ফি আদায় করেন। অতিরিক্ত ফি’র কোন রশিদ দেন না তিনি।

তাঁর যোগদানের পর থেকে এ পর্যন্ত বিদ্যালয়ে প্রত্যেক শিক্ষক ও কর্মচারি নিয়োগে বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। তাদের এমপিও ভূক্তকরণের জন্য ঘুষের কথা বলে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। বিদ্যালয়ে সংস্কার কাজ, প্রাচীর নির্মাণসহ সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের নামেমাত্র কাজ করে অর্থ লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে। বিদ্যালয়ের জায়গায় বাড়াদিয়া বাজারে পাঁচটি দোকান ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি কক্ষ ১ লাখ টাকা অগ্রিম ও মাসিক ২ হাজার টাকা ভাড়া দেয়া হয়েছে। মার্কেট নির্মাণ ও ভাড়ার অর্থ গড়মিলের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া, বিদ্যালয়ের আয়-ব্যয়ের হিসাবে অতিরিক্ত ও কাল্পনিক ভাউচারে লাখ লাখ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে।

২০০৫ সালে নৈশপ্রহরী ও আয়া নিয়োগ দেন প্রধান শিক্ষক। এই নিয়োগপ্রাপ্ত নৈশপ্রহরি মো. বাদশা মিয়া ২০০৪ সালে থেকে বিদ্যালয়ে কর্মরত থাকলেও তাকে নিয়োগ দেখানো হয় ২০০৫ সালেই। ২০১৯ সাল পর্যন্ত দায়িত্বপালন করেছেন বাদশা। তাকে দিয়ে নৈশ প্রহরির দায়িত্বপালন করা ছাড়াও প্রধান শিক্ষকের পারিবারিক কাজ করানো হতো। এমপিওভূক্ত না থাকলও তাকে যথাক্রমে ৮০০, ১৫০০ ও ২০০০ টাকা ভাতা দেয়া হতো। এমপিওভুক্ত করার কথা বলে তার কাছ থেকে প্রধান শিক্ষক ৯ হাজার টাকা ঘুষ নেন। পরে এমপিওভূক্ত না হওয়ায় চাকুরি ছেড়ে দেন তিনি। এছাড়া সুবিয়াকে বিদ্যালয়ের আয়া নিয়োগ দেয়া হয় ২০০৫ সালে। নিয়োগের ছয় মাস পর্যন্ত ৪০০/৫০০ টাকা মাসিক ভাতা দেয়া হতো। এমপিওভূক্ত না হওয়ায় তিনি বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করে দেন। এরপর ২০১১ সালে এমপিওভূক্ত করার কথা বলে সুবিয়ার কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা ঘুষ ও নিয়োগপত্র নিয়ে নেন প্রধান শিক্ষক। পরে তাকেও আর নিয়োগ দেয়া হয়নি।

এরপর বিদ্যালয়ে মো. রাজিব হোসেনকে নৈশপ্রহরি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তিনি চাকুরি করেন ঢাকায়। প্রধান শিক্ষকের যোগসাযশে হাজিরায় স্বাক্ষর করে মাসিক ৮২৫০ টাকা স্কেলে বেতন তুলে নেন রাজিব। কিন্তু রাজিবের পিতা রশিদ বিদ্যালয়ে নৈশপ্রহরির দায়িত্বপালন করেন। তিনিও প্রধান শিক্ষকের পারিবারিক কাজ করেন। রশিদ বয়স্ক হওয়ায় তাকে নিয়ম অনুযায়ী নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয়নি। তাই রাজিবকে নিয়োগ দিয়ে তার পিতাকে দিয়ে দায়িত্বপালন করানো হচ্ছে

এ বিষয়ে ভূক্তভোগি সাবেক নৈশপ্রহরি মো. বাদশা মিয়া বলেন,‘২০০৪ সাল থেকে বিদ্যালয়ে নৈশপ্রহরির দায়িত্বপালন করলেও আমাকে নিয়োগ দেয়া হয়ে ২০০৫ সালে। রাতে বিদ্যালয়ে প্রহরির দায়িত্বপালন করলেও দিনে প্রধান শিক্ষকের পারিবারিক কাজ করতে হতো। ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিদ্যালয়ে এভাবেই কাজ করেছি। নামেমাত্র বেতন দেয়া হতো। এমপিওভূক্ত করার কথা বলে আমার কাছ থেকে প্রধান শিক্ষক ৯ হাজার টাকা ঘুম নিয়েছেন। কিন্তু বেতন না বাড়ায় চাকুরি দেড়ে দিয়েছি।

আরেক ভূক্তভোগি সুবিয়া অভিযোগ করে বলেন,‘২০০৫ সালে আমাকে আয়া নিয়োগ দেয়া হয়। ৪০০/৫০০ টাকা আমাকে বেতন দেয়া হতো। তাই ছয় মাস কাজ করে আর বিদ্যালয়ে যাইনি। পরে ২০১১ সালে প্রধান শিক্ষক আমাকে বেতন বাড়ানোর কথা বলে ১০ হাজার টাকা ও নিয়োগপত্র নিয়ে নেন। পরে আর আমাকে নিয়োগ দেয়া হয়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদ্যালয়ের মার্কেটের কয়েকজন ভাড়াটিয়া জানান, ১ লাখ টাকা অগ্রিম ও মাসিক ২ হাজার টাকা ভাড়ায় প্রধান শিক্ষকের কাছ দোকান ঘর ভাড়া নিয়েছেন তারা। কিন্তু, এ সংক্রান্ত কাগজপত্র দেখাতে চাননি তারা।

বর্তমান নৈশপ্রহরি রাজিবের মাতা সাংবাদিকদের বলেন,‘রাজিব আগে ঢাকায় চাকুরি করে।

স্থানীয়রা ও ভূক্তভোগিরা অভিযোগ করে আরও জানান, উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে প্রধান শিক্ষকের এসব নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির লিখিত অভিযোগ দেয়ার পর থেকেই নানাভাবে হুমকি-দামকি দেয়া হচ্ছে। অভিযোগকারীদের কাছে গিয়ে অভিযোগ প্রত্যাহার করার জন্য লোকজন দিয়ে ম্যানেজের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ওই প্রধান শিক্ষক। তাই দ্রুত অভিযোগ তদন্তের জন্য উর্ধ্বতন কর্মকর্তার দৃষ্টি কামনা করেছেন তারা।

এ ব্যাপারে শিবালয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পদাধিকার বলে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মো. বেলাল হোসেন বলেন, ‘প্রধান শিক্ষকের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে স্থায়ী বরখাস্তের জন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, অভিভাবক, এলাকাবাসী ও ভূক্তভোগিরা লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। বিদ্যালয়ের অ্যাডহক কমিটি নেই। তাই বিষয়টি তদন্ত ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে পাঠানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে অনুলিপিও পাঠানো হয়েছে।’

Comments are closed.

     এই বিভাগের আরও সংবাদ