রাউফুর রহমান পরাগঃ দেশে স্বল্প খরচে স্বাস্থ্য সেবা পেতে নিম্নবিত্ত পরিবারের মূল ভরসা এখনো সরকারি হাসপাতাল। তবে বেসরকারি খাতে চিকিৎসা সেবার খরচ ব্যয়বহুল হলেও এ খাতে অংশগ্রহণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। যদিও সরকারি হাসপাতালের সংখ্যা পর্যাপ্ত না থাকায় অনেকটা বাধ্য হয়েই বেসরকারি হাসপাতেল চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন মানুষ।
এমন চিত্র দেখা যায় দেশের সবচেয়ে জনবহুল এলাকা শিল্পাঞ্চল সাভার ও আশুলিয়ায়। যেখানে এখনো একটি সরকারি হাসপাতালে ব্যবস্থা করতে পারেনি দেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
সাভার উপজেলায় প্রায় ৩০ লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। সেখানে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ছাড়া অন্য কোনো সরকারি হাসপাতাল নেই। তাও আবার মাত্র ৫০ শয্যা বিশিষ্ট।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি সাভার থানাধীন এলাকায় অবস্থিত। যার ফলে আশুলিয়ায় শ্রমিকরা সেখানে খুব একটা যান না। অন্যদিকে আশুলিয়াতে নেই কোন সরকারি হাসপাতালে নেই। তাই এখানে একটি সরকারি হাসপাতালের দাবি আশুলিয়ায় কর্মরত শ্রমিকদের।
দেশে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের সব চেয়ে বড় সংগঠন বিজিএমইএ। পোশাক শ্রমিকদের জন্য আশুলিয়ায় বিজিএমই‘র একটি হেল্প সেন্টার থাকলেও সেখানে ভালো কোনো চিকিৎসক না থাকায় অনেকে যেখানে যান না। তবে বেশির ভাগ শ্রমিকরা এই হেল্প সেন্টারের তথ্য জানেন না।
অন্যদিকে, শিল্পাঞ্চল আশুলিয়া সাধারণ মানুষ, সচেতন মহল, শ্রমিক ও বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীদের নতুন দাবি হচ্ছে, বাংলাদেশে নতুন করে চীনের যে তিনটি বিশেষায়িত হাসপাতাল করার প্রস্তাব রয়েছে তার মধ্যে একটি যেন আশুলিয়ার শিল্পাঞ্চলে করা হয়।
আশুলিয়ায় কর্মরত শ্রমিকরা জানান, যে কোনো ধরণের রোগের জন্য আমাদের বেসরকারি হাসপাতালে যেতে হয়। কারণ আশুলিয়াতে কোনো সরকারি হাসপাতাল নেই। কিন্তু আমরা যে পরিমান বেতন পাই, তা দিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করানো আমাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। কারণ আপনারা জানেন বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা খরচ অনেক ব্যয় বহুল।
স্বল্প খরচে আশুলিয়ায় কর্মরত শ্রমিকদের সু-চিকিৎসা নিশ্চিত করতে একটি সরকারি হাসপাতালের বিকল্প নেই বলেও তারা জানান।
হামীম গ্রুপের সন্তানসম্ভবা নারী শ্রমিক রোজিনা জানান, আমি গত দুই দিন আগে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ি, আমাদের অফিসের ডাক্তার আমাকে দেখে বলে একজন গাইনি ডাক্তারের পরামর্শ নিতে, তাই আমি জামগড়া একটি প্রাইভেট হাসপাতালে যাই, সেখানে গেলে এই পরিক্ষা সেই পরিক্ষা করে মোটা অংকের একটা বিল ধরাই দিলো। কত টাকাই বেতন পায় বলেন।
তিনি আরও বলেন, এক মাস পরেই ডেলিভারি তারিখ বলেছে ডাক্তার। প্রাইভেট হাসপাতাল গুলোতে যে খরচ। তা নিয়ে রীতিমত হতাশার মধ্য দিয়ে দিন পার করছি। আশুলিয়ায় একটি সরকারি হাসপাতাল থাকলে আমাদের মত শ্রমিকদের অনেক উপকার হতো।
আশুলিয়া একটি সরকারি হাসপাতালের দাবি জানিয়ে রোজিনা বলেন, আমি বর্তমান সরকারের নিকট আপনাদের মাধ্যমে আবেদন জানাই, তিনি যেন শ্রমিকদের কথা মাথায় রেখে আশুলিয়ায় একটি সরকারি হাসপাতাল করেন।
রিক্সা চালক শহিদুল ইসলাম বলেন, আমার ভাগিনার হঠাৎ বুকে ব্যথা হয়। পরে তাকে নিয়ে আশুলিয়ার সরকার মার্কেট এলাকার একটি হাসপাতালে নিয়ে যাই। ডাক্তার দেখেই ভর্তি করতে বলেন। আবার কিছুক্ষন পড়েই বলে তাকে আইসিইউতে নিতে হবে। উপায় দিক না পেয়ে তাকে আইসিইউতে নেওয়ার জন্য বলি।
কিন্তু দুই দিন না হতেই হাতে ৭৪ হাজার টাকার বিল ধরাই দেয়। তারপর নিজ জিম্মায় রোগী নিয়ে গ্রামে বাড়ীতে পাঠাই দেয়।
হাসপাতালে বিল পরিক্ষাসহ আমার প্রায় লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত বিল পরিশোধ করতে আমাকে লোন করতে হয়েছে।
ইথিক্যাল গার্মেন্টসের পোশাক শ্রমিক মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, আমি কিছুদিন আগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হই। তখন আমার প্লাটিলেট অনেক কমে যায়। এসময় আমার কারখানার ডাক্তার আমাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে বলে। আমি একজন পোশাক শ্রমিক। আমি কি প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা করতে পারি? কত টাকাই বেতন পায় আমি। যার ফলে আমি কুর্মিটলা হাসপাতালে ভর্তি হই। তবে আশুলিয়া থেকে যাওয়া আসা অনেক কষ্ট কর। আশুলিয়াতে যদি একটা সরকারি হাসপাতাল থাকতো তাহলে আমার মত অনেক গরীব লোকের চিকিৎসা করতে পারতো।
শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায় একটি সরকারি হাসপাতালে জন্য বিজিএমইএ সহ সরকারি বিভিন্ন মাধ্যমে অনেকবার আমরা অনুরোধ করেছি কিন্তু এখন পর্যন্ত একটি সরকারি হাসপাতালে কোনো কার্যক্রম দেখছি না- এ কথা গুলো বলছিলেন শ্রমিক নেতা সরোয়ার হোসেন।
তিনি আরও বলেন, উৎপাদনের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আশুলিয়াতে কোনো সরকারি হাসপাতালে নেই। প্রাইভেট যে হাসপাতাল গুলো আছে, সেখানে খরচ অনেক বেশি। শ্রমিকরা যে পরিমাণ বেতন পান তাতে তাদের প্রাইভেটে চিকিৎসা করানো সবার পক্ষে সম্ভব না।
এ সময় তিনি চীনের প্রস্তাবিত তিনটি বিশেষায়িত হাসপাতালের মধ্যে একটি হাসপাতাল আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে স্থাপনের দাবিও জানান।
সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার তৌহিদ আল হাসান বলেন, আশুলিয়ায় একটি সরকারি হাসপাতাল স্থাপন করা খুবই জরুরি। হাসাপাতাল স্থাপন করার জন্য জমি দরকার। যদি কেউ জমি দান করতে চান, সেক্ষেত্রে আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। আমরা আশুলিয়াতে একটি হাসপাতাল করার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রপোজাল পাঠাবো। পাশাপাশি আমাদের খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে হাসপাতালে করার মত আশুলিয়াতে সরকারি খাস জমি কোথায় পাওয়া যায়।
এ সময় তিনি আরো বলেন, আমাদের একটি মাসিক সমন্বয় সভা হয়। সেখানে ঢাকা জেলার সিভিল সার্জন মহোদয় সহ হেলথ ডিপার্টমেন্টের বড় বড় কর্মকর্তারা থাকেন। সেখানে আমি এই বিষয়টি উত্থাপন করবো।
যদি সরকারের নতুন কোনো হাসপাতাল করার ইচ্ছে থাকে তা যেন আশুলিয়াতে করা হয় এই প্রস্তাবনা আমি রাখবো।