০৮:১৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫, ৯ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ইসলামের দৃষ্টিতে মানবাধিকার: কমিশনের বিভ্রান্তি ও কুরআন-সুন্নাহর সঠিক নির্দেশনা

 

✍️মাওলানা শেখ মিলাদ হোসাইন সিদ্দিকীঃ ভূমিকাঃ মানুষ আল্লাহর সৃষ্টির সেরা জীব। আল্লাহ তাকে সম্মানিত করেছেন এবং পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছেন। এই সম্মান ও দায়িত্বকে ইসলামে বলা হয় হক (অধিকার) ও দায়িত্ব।

কিন্তু পাশ্চাত্য সভ্যতা ও জাতিসংঘের প্রবর্তিত তথাকথিত মানবাধিকার সনদ (UDHR 1948) ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক অনেক ধারণা প্রচার করেছে।
এগুলো ভিত্তি করে বাংলাদেশসহ অনেক দেশে গঠন করা হয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।
যার উদ্দেশ্য ও কাজের ধরন অনেকাংশেই ইসলামী শরীয়াহর পরিপন্থী।

মানবাধিকার কমিশনের মূল এজেন্ডা ও দাবি

বাংলাদেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রচলিত মানবাধিকার কমিশনের মূল নীতিগুলো এরকম—
(এগুলো জাতিসংঘ ঘোষিত Universal Declaration of Human Rights এর ধারা থেকে এসেছে।)

১. ধর্মনিরপেক্ষতা (Secularism)
— রাষ্ট্র কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম মেনে চলবে না।
— ধর্ম ও রাষ্ট্র আলাদা।

২. বিশ্বাস ও ধর্ম পরিবর্তনের অধিকার

— যে কেউ যে কোনো ধর্মে যেতে পারবে বা ধর্মত্যাগ করতে পারবে।

৩. মতপ্রকাশ ও চিন্তার স্বাধীনতা

— মানুষ যা খুশি বলবে, এমনকি ধর্ম ও নবীকে বিদ্রূপ করলেও কোনো শাস্তি হবে না।

৪. সমকামী অধিকার (LGBTQ Rights)

— সমলিঙ্গে প্রেম বা বিয়ে বৈধ এবং অধিকার।

৫. নারীর পূর্ণ স্বাধীনতা ও লিঙ্গ সমতা

— নারী ও পুরুষকে সবক্ষেত্রে সমান মর্যাদা ও দায়িত্ব দিতে হবে।

৬. দেহের ওপর পূর্ণ অধিকার
গর্ভপাত, লিভ-টুগেদার, বিকৃত যৌনতা সবই ব্যক্তির অধিকার।

৭. ধর্মীয় আইন বাতিল করে “মানবিক” আইন কায়েম

— শরীয়াহকে অমানবিক আখ্যা দিয়ে তা বাতিল করা ও নতুন আইন প্রণয়ন।

এই পর্যায়ে আমরা দেখলাম: মানবাধিকার কমিশন যে এজেন্ডাগুলো নিয়ে কাজ করে, সেগুলো আসলে পশ্চিমা সভ্যতার ‘মানব-কেন্দ্রিক’ চিন্তাধারার ফসল।

কিন্তু ইসলাম আল্লাহ-কেন্দ্রিক ন্যায়বিচার ও দায়িত্বপূর্ণ স্বাধীনতার শিক্ষা দেয়।

মানবাধিকার কমিশনের দাবিগুলো ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক — কুরআন ও হাদীসের আলোকে বিশ্লেষণ

১. ধর্মনিরপেক্ষতা (Secularism)
কমিশনের দাবি:
রাষ্ট্র কোনো ধর্ম মেনে চলবে না। ধর্ম থাকবে ব্যক্তিগত বিষয়ে।

ইসলামের শিক্ষা:
রাষ্ট্র, সমাজ, ব্যক্তিজীবন—সবকিছু আল্লাহর বিধানের অধীন। ধর্মকে শুধু ব্যক্তিগত ইবাদতে সীমাবদ্ধ করা ইসলামে হারাম।

আল্লাহ বলেন:

أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ
“তারা কি জাহেলিয়াতের আইন কামনা করে? আর যারা বিশ্বাস করে, তাদের জন্য আল্লাহর বিধানের চেয়ে উত্তম আর কে?”
(সূরা মায়িদা: ৫০)

রাসূল ﷺ মদীনায় পূর্ণ ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন—যেখানে ধর্ম ও রাষ্ট্র আলাদা ছিল না।

২. বিশ্বাস পরিবর্তনের অধিকার

কমিশনের দাবি:
যে কেউ যে কোনো ধর্ম ত্যাগ বা পরিবর্তন করতে পারবে।
ইসলামের শিক্ষা:
ধর্মত্যাগ (রিদ্দা) করা মারাত্মক গুনাহ এবং ইসলামী রাষ্ট্রে শাস্তিযোগ্য।

আল্লাহ বলেন:

وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ
“যে ইসলাম ব্যতীত অন্য ধর্ম গ্রহণ করবে, তা কবুল করা হবে না।”
(সূরা আলে ইমরান: ৮৫)

রাসূল ﷺ বলেন:
«مَنْ بَدَّلَ دِينَهُ فَاقْتُلُوهُ»
“যে তার দ্বীন পরিবর্তন করবে, তাকে হত্যা করো।”
(সহীহ বুখারি)

৩. মতপ্রকাশের স্বাধীনতা

কমিশনের দাবি:
যে যা খুশি বলবে—ধর্ম, নবী, কুরআনের বিরুদ্ধেও কথা বলার অধিকার থাকবে।

ইসলামের শিক্ষা:
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে, কিন্তু শর্ত হলো তা হতে হবে সত্য, ইনসাফ ও সম্মানজনক। কুফরি ও বিদ্রূপের কোনো অধিকার নেই।

আল্লাহ বলেন:

قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالإِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَنْ تُشْرِكُوا بِاللَّهِ…
“বলুন: আমার প্রতিপালক হারাম করেছেন অশ্লীলতা—প্রকাশ্য ও গোপন, এবং অন্যায়ভাবে সীমালঙ্ঘন ও আল্লাহর সাথে শিরক।”
(সূরা আরাফ: ৩৩)

রাসূল ﷺ বলেন:

«من كان يؤمن بالله واليوم الآخر فليقل خيرا أو ليصمت»
“যে আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে।”
(সহীহ বুখারি ও মুসলিম)

৪. সমকামী অধিকার (LGBTQ Rights)
কমিশনের দাবি:
সমলিঙ্গে প্রেম বা বিয়ে বৈধ ও অধিকার।

ইসলামের শিক্ষা:
সমকামীতা জঘন্যতম হারাম কাজ। লূতের কওমকে এই অপরাধে ধ্বংস করা হয়েছিল।

আল্লাহ বলেন:

وَلُوطًا إِذْ قَالَ لِقَوْمِهِ أَتَأْتُونَ الْفَاحِشَةَ مَا سَبَقَكُم بِهَا مِنْ أَحَدٍ مِّنَ الْعَالَمِينَ
“লোত বললেন: তোমরা কি অশ্লীল কাজ করছ যা তোমাদের আগে দুনিয়ার কেউ করেনি?”
(সূরা আরাফ: ৮০)

রাসূল ﷺ বলেন:

«لعن الله من عمل عمل قوم لوط»
“যে লূতের কওমের কাজ করবে, আল্লাহ তাকে অভিশাপ করেছেন।”
(তিরমিজি)

৫. নারীর পূর্ণ স্বাধীনতা ও লিঙ্গ সমতা।

কমিশনের দাবি:
নারী-পুরুষ সবক্ষেত্রে সমান। পরিবারের নেতৃত্বে কোনো পার্থক্য থাকবে না।

ইসলামের শিক্ষা:
পুরুষ ও নারী সমান মর্যাদার অধিকারী। তবে দায়িত্ব ও অবস্থানে ভিন্নতা।
আল্লাহ বলেন:
الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللَّهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ
“পুরুষরা নারীদের অভিভাবক, যেহেতু আল্লাহ তাদের একের উপর অন্যকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন।”
(সূরা নিসা: ৩৪)

রাসূল ﷺ নারীর প্রতি সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু পুরুষকেই পরিবারপ্রধান হিসেবে স্থির করেছেন।
৬. গর্ভপাত ও দেহের ওপর পূর্ণ অধিকার

কমিশনের দাবি:
নারী চাইলে গর্ভপাত করতে পারবে। তার দেহ নিয়ে যা ইচ্ছা করবে।

ইসলামের শিক্ষা:
গর্ভপাত অন্যায়ভাবে সন্তান হত্যা।

আল্লাহ বলেন:

وَلَا تَقْتُلُوا أَوْلادَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلاقٍ
“দারিদ্র্যের ভয়ে তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না।”
(সূরা ইসরা: ৩১)

রাসূল ﷺ বলেন:

«إن الله قد كتب مقادير الخلائق»
“আল্লাহ সৃষ্টির তাকদীর নির্ধারণ করেছেন।”
(সহীহ মুসলিম)

৭. শরীয়াহ বিরোধী আইন চাপানো

কমিশনের দাবি:
শরীয়াহ ভিত্তিক বিচার ও আইন মানবাধিকারের লঙ্ঘন।

ইসলামের শিক্ষা:
শরীয়াহর বাইরে কোনো বিচার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হারাম।

আল্লাহ বলেন:

> وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ
“যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী বিচার করে না, তারা জালিম।”
(সূরা মায়িদা: ৪৫)

মানবাধিকার কমিশনের কারণে সমাজে ক্ষতি ও ইসলামী সমাধান

প্রথমত: মানবাধিকার কমিশনের কারণে সমাজে সৃষ্ট ক্ষতি

(১) ইসলামী শাসন ও শরীয়াহ ক্ষতিগ্রস্ত

মানবাধিকার কমিশন ইসলামী শরীয়াহভিত্তিক আইন ও বিচারকে “মানবাধিকারের লঙ্ঘন” বলে। ফলে কুরআন-সুন্নাহর আইন উপেক্ষিত হয়।
অথচ আল্লাহ বলেন:

وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ
“যারা বিশ্বাস করে, তাদের জন্য আল্লাহর বিধানের চেয়ে উত্তম আর কে?”
(সূরা মায়িদা: ৫০)

ফলে মুসলিম সমাজের বিচার ও আইন ব্যবস্থায় জাহেলিয়াত কায়েম হয়।

(২) অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা বৃদ্ধি

কমিশনের সমর্থন ও প্রশ্রয়ে সমাজে সমকামীতা, লিভ-টুগেদার, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, বেহায়াপনা বৈধ হয়ে যায়।
অথচ আল্লাহ বলেন:

إِنَّ الَّذِينَ يُحِبُّونَ أَنْ تَشِيعَ الْفَاحِشَةُ فِي الَّذِينَ آمَنُوا لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
“যারা চায় মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ুক, তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।”
(সূরা নূর: ১৯)

(৩) পরিবার ব্যবস্থা ধ্বংস

নারী-পুরুষ সমতার নামে পরিবারের নেতৃত্ব ও ভারসাম্য ভেঙে যায়। বিবাহপ্রথা ও সন্তান পালনের দায়িত্ব উপেক্ষিত হয়।
অথচ আল্লাহ বলেন:

الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ
“পুরুষরা নারীদের অভিভাবক।”
(সূরা নিসা: ৩৪)
ফলে বিবাহ ও পরিবার-ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়।

(৪) যুবসমাজের ঈমান নষ্ট

অবাধ স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও নাস্তিকতা যুবদের ঈমান ও আমল নষ্ট করে।
আল্লাহ বলেন:

فَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ
“যেমন নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তুমি তেমনই অবিচল থাকো।”
(সূরা হুদ: ১১২)

কমিশনের নীতি মুসলিম যুবদের গাফেল ও বিভ্রান্ত করে।

(৫) নাস্তিকতা ও ধর্মদ্রোহ প্রসার

ধর্মত্যাগ, ধর্মবিদ্বেষ ও কুরআন-হাদীসের সমালোচনা সমাজে স্বাভাবিক হয়ে যায়।
অথচ রাসূল ﷺ বলেছেন:

«من بدل دينه فاقتلوه»
“যে তার দ্বীন পরিবর্তন করবে, তাকে হত্যা করো।”
(সহীহ বুখারি)
ইসলামবিরোধী প্রচারণা বাড়ে।

দ্বিতীয়ত: ইসলামী সমাধান ও করণীয়

(১) কুরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা

মানুষের প্রকৃত অধিকার হলো আল্লাহর দেয়া অধিকার।
আল্লাহ বলেন:

وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ
“আমি তো আদম সন্তানদেরকে সম্মানিত করেছি।”
(সূরা ইসরা: ৭০)

তাই শরীয়াহ মেনে অধিকার রক্ষা করতে হবে।

(২) ইসলামী শিক্ষা ও দাওয়াত প্রচার

যুবসমাজ ও নারীদের কুরআন-সুন্নাহ শিক্ষা দিয়ে সচেতন করা।
ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য তুলে ধরা।
রাসূল ﷺ বলেন:

«بلغوا عني ولو آية»
“আমার পক্ষ থেকে এক আয়াত হলেও পৌঁছে দাও।”
(সহীহ বুখারি)

(৩) শরীয়াহভিত্তিক আইন বাস্তবায়ন

রাষ্ট্র ও সমাজে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে আল্লাহর আইন অনুযায়ী।
আল্লাহ বলেন:

وَأَنِ احْكُم بَيْنَهُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ
“তুমি তাদের মধ্যে আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা অনুযায়ী বিচার করো।”
(সূরা মায়িদা: ৪৯)

(৪) মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সহযোগিতা জোরদার করা

বিভক্তি ও শত্রুতা পরিহার করে ইসলামী ঐক্য গড়ে তোলা।
আল্লাহ বলেন:

وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا
“তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধরো এবং বিভক্ত হয়ো না।”
(সূরা আলে ইমরান: ১০৩)

Tag :
About Author Information

জনপ্রিয়

কালিগঞ্জের বসন্তপুরে সীমান্ত অপরাধ প্রতিরোধে সচেতনতামূলক সভা

ইসলামের দৃষ্টিতে মানবাধিকার: কমিশনের বিভ্রান্তি ও কুরআন-সুন্নাহর সঠিক নির্দেশনা

প্রকাশের সময়ঃ ১০:০৯:০৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫

 

✍️মাওলানা শেখ মিলাদ হোসাইন সিদ্দিকীঃ ভূমিকাঃ মানুষ আল্লাহর সৃষ্টির সেরা জীব। আল্লাহ তাকে সম্মানিত করেছেন এবং পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছেন। এই সম্মান ও দায়িত্বকে ইসলামে বলা হয় হক (অধিকার) ও দায়িত্ব।

কিন্তু পাশ্চাত্য সভ্যতা ও জাতিসংঘের প্রবর্তিত তথাকথিত মানবাধিকার সনদ (UDHR 1948) ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক অনেক ধারণা প্রচার করেছে।
এগুলো ভিত্তি করে বাংলাদেশসহ অনেক দেশে গঠন করা হয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।
যার উদ্দেশ্য ও কাজের ধরন অনেকাংশেই ইসলামী শরীয়াহর পরিপন্থী।

মানবাধিকার কমিশনের মূল এজেন্ডা ও দাবি

বাংলাদেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রচলিত মানবাধিকার কমিশনের মূল নীতিগুলো এরকম—
(এগুলো জাতিসংঘ ঘোষিত Universal Declaration of Human Rights এর ধারা থেকে এসেছে।)

১. ধর্মনিরপেক্ষতা (Secularism)
— রাষ্ট্র কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম মেনে চলবে না।
— ধর্ম ও রাষ্ট্র আলাদা।

২. বিশ্বাস ও ধর্ম পরিবর্তনের অধিকার

— যে কেউ যে কোনো ধর্মে যেতে পারবে বা ধর্মত্যাগ করতে পারবে।

৩. মতপ্রকাশ ও চিন্তার স্বাধীনতা

— মানুষ যা খুশি বলবে, এমনকি ধর্ম ও নবীকে বিদ্রূপ করলেও কোনো শাস্তি হবে না।

৪. সমকামী অধিকার (LGBTQ Rights)

— সমলিঙ্গে প্রেম বা বিয়ে বৈধ এবং অধিকার।

৫. নারীর পূর্ণ স্বাধীনতা ও লিঙ্গ সমতা

— নারী ও পুরুষকে সবক্ষেত্রে সমান মর্যাদা ও দায়িত্ব দিতে হবে।

৬. দেহের ওপর পূর্ণ অধিকার
গর্ভপাত, লিভ-টুগেদার, বিকৃত যৌনতা সবই ব্যক্তির অধিকার।

৭. ধর্মীয় আইন বাতিল করে “মানবিক” আইন কায়েম

— শরীয়াহকে অমানবিক আখ্যা দিয়ে তা বাতিল করা ও নতুন আইন প্রণয়ন।

এই পর্যায়ে আমরা দেখলাম: মানবাধিকার কমিশন যে এজেন্ডাগুলো নিয়ে কাজ করে, সেগুলো আসলে পশ্চিমা সভ্যতার ‘মানব-কেন্দ্রিক’ চিন্তাধারার ফসল।

কিন্তু ইসলাম আল্লাহ-কেন্দ্রিক ন্যায়বিচার ও দায়িত্বপূর্ণ স্বাধীনতার শিক্ষা দেয়।

মানবাধিকার কমিশনের দাবিগুলো ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক — কুরআন ও হাদীসের আলোকে বিশ্লেষণ

১. ধর্মনিরপেক্ষতা (Secularism)
কমিশনের দাবি:
রাষ্ট্র কোনো ধর্ম মেনে চলবে না। ধর্ম থাকবে ব্যক্তিগত বিষয়ে।

ইসলামের শিক্ষা:
রাষ্ট্র, সমাজ, ব্যক্তিজীবন—সবকিছু আল্লাহর বিধানের অধীন। ধর্মকে শুধু ব্যক্তিগত ইবাদতে সীমাবদ্ধ করা ইসলামে হারাম।

আল্লাহ বলেন:

أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ
“তারা কি জাহেলিয়াতের আইন কামনা করে? আর যারা বিশ্বাস করে, তাদের জন্য আল্লাহর বিধানের চেয়ে উত্তম আর কে?”
(সূরা মায়িদা: ৫০)

রাসূল ﷺ মদীনায় পূর্ণ ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন—যেখানে ধর্ম ও রাষ্ট্র আলাদা ছিল না।

২. বিশ্বাস পরিবর্তনের অধিকার

কমিশনের দাবি:
যে কেউ যে কোনো ধর্ম ত্যাগ বা পরিবর্তন করতে পারবে।
ইসলামের শিক্ষা:
ধর্মত্যাগ (রিদ্দা) করা মারাত্মক গুনাহ এবং ইসলামী রাষ্ট্রে শাস্তিযোগ্য।

আল্লাহ বলেন:

وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ
“যে ইসলাম ব্যতীত অন্য ধর্ম গ্রহণ করবে, তা কবুল করা হবে না।”
(সূরা আলে ইমরান: ৮৫)

রাসূল ﷺ বলেন:
«مَنْ بَدَّلَ دِينَهُ فَاقْتُلُوهُ»
“যে তার দ্বীন পরিবর্তন করবে, তাকে হত্যা করো।”
(সহীহ বুখারি)

৩. মতপ্রকাশের স্বাধীনতা

কমিশনের দাবি:
যে যা খুশি বলবে—ধর্ম, নবী, কুরআনের বিরুদ্ধেও কথা বলার অধিকার থাকবে।

ইসলামের শিক্ষা:
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে, কিন্তু শর্ত হলো তা হতে হবে সত্য, ইনসাফ ও সম্মানজনক। কুফরি ও বিদ্রূপের কোনো অধিকার নেই।

আল্লাহ বলেন:

قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالإِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَنْ تُشْرِكُوا بِاللَّهِ…
“বলুন: আমার প্রতিপালক হারাম করেছেন অশ্লীলতা—প্রকাশ্য ও গোপন, এবং অন্যায়ভাবে সীমালঙ্ঘন ও আল্লাহর সাথে শিরক।”
(সূরা আরাফ: ৩৩)

রাসূল ﷺ বলেন:

«من كان يؤمن بالله واليوم الآخر فليقل خيرا أو ليصمت»
“যে আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে।”
(সহীহ বুখারি ও মুসলিম)

৪. সমকামী অধিকার (LGBTQ Rights)
কমিশনের দাবি:
সমলিঙ্গে প্রেম বা বিয়ে বৈধ ও অধিকার।

ইসলামের শিক্ষা:
সমকামীতা জঘন্যতম হারাম কাজ। লূতের কওমকে এই অপরাধে ধ্বংস করা হয়েছিল।

আল্লাহ বলেন:

وَلُوطًا إِذْ قَالَ لِقَوْمِهِ أَتَأْتُونَ الْفَاحِشَةَ مَا سَبَقَكُم بِهَا مِنْ أَحَدٍ مِّنَ الْعَالَمِينَ
“লোত বললেন: তোমরা কি অশ্লীল কাজ করছ যা তোমাদের আগে দুনিয়ার কেউ করেনি?”
(সূরা আরাফ: ৮০)

রাসূল ﷺ বলেন:

«لعن الله من عمل عمل قوم لوط»
“যে লূতের কওমের কাজ করবে, আল্লাহ তাকে অভিশাপ করেছেন।”
(তিরমিজি)

৫. নারীর পূর্ণ স্বাধীনতা ও লিঙ্গ সমতা।

কমিশনের দাবি:
নারী-পুরুষ সবক্ষেত্রে সমান। পরিবারের নেতৃত্বে কোনো পার্থক্য থাকবে না।

ইসলামের শিক্ষা:
পুরুষ ও নারী সমান মর্যাদার অধিকারী। তবে দায়িত্ব ও অবস্থানে ভিন্নতা।
আল্লাহ বলেন:
الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللَّهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ
“পুরুষরা নারীদের অভিভাবক, যেহেতু আল্লাহ তাদের একের উপর অন্যকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন।”
(সূরা নিসা: ৩৪)

রাসূল ﷺ নারীর প্রতি সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু পুরুষকেই পরিবারপ্রধান হিসেবে স্থির করেছেন।
৬. গর্ভপাত ও দেহের ওপর পূর্ণ অধিকার

কমিশনের দাবি:
নারী চাইলে গর্ভপাত করতে পারবে। তার দেহ নিয়ে যা ইচ্ছা করবে।

ইসলামের শিক্ষা:
গর্ভপাত অন্যায়ভাবে সন্তান হত্যা।

আল্লাহ বলেন:

وَلَا تَقْتُلُوا أَوْلادَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلاقٍ
“দারিদ্র্যের ভয়ে তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না।”
(সূরা ইসরা: ৩১)

রাসূল ﷺ বলেন:

«إن الله قد كتب مقادير الخلائق»
“আল্লাহ সৃষ্টির তাকদীর নির্ধারণ করেছেন।”
(সহীহ মুসলিম)

৭. শরীয়াহ বিরোধী আইন চাপানো

কমিশনের দাবি:
শরীয়াহ ভিত্তিক বিচার ও আইন মানবাধিকারের লঙ্ঘন।

ইসলামের শিক্ষা:
শরীয়াহর বাইরে কোনো বিচার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হারাম।

আল্লাহ বলেন:

> وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ
“যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী বিচার করে না, তারা জালিম।”
(সূরা মায়িদা: ৪৫)

মানবাধিকার কমিশনের কারণে সমাজে ক্ষতি ও ইসলামী সমাধান

প্রথমত: মানবাধিকার কমিশনের কারণে সমাজে সৃষ্ট ক্ষতি

(১) ইসলামী শাসন ও শরীয়াহ ক্ষতিগ্রস্ত

মানবাধিকার কমিশন ইসলামী শরীয়াহভিত্তিক আইন ও বিচারকে “মানবাধিকারের লঙ্ঘন” বলে। ফলে কুরআন-সুন্নাহর আইন উপেক্ষিত হয়।
অথচ আল্লাহ বলেন:

وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ
“যারা বিশ্বাস করে, তাদের জন্য আল্লাহর বিধানের চেয়ে উত্তম আর কে?”
(সূরা মায়িদা: ৫০)

ফলে মুসলিম সমাজের বিচার ও আইন ব্যবস্থায় জাহেলিয়াত কায়েম হয়।

(২) অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা বৃদ্ধি

কমিশনের সমর্থন ও প্রশ্রয়ে সমাজে সমকামীতা, লিভ-টুগেদার, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, বেহায়াপনা বৈধ হয়ে যায়।
অথচ আল্লাহ বলেন:

إِنَّ الَّذِينَ يُحِبُّونَ أَنْ تَشِيعَ الْفَاحِشَةُ فِي الَّذِينَ آمَنُوا لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
“যারা চায় মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ুক, তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।”
(সূরা নূর: ১৯)

(৩) পরিবার ব্যবস্থা ধ্বংস

নারী-পুরুষ সমতার নামে পরিবারের নেতৃত্ব ও ভারসাম্য ভেঙে যায়। বিবাহপ্রথা ও সন্তান পালনের দায়িত্ব উপেক্ষিত হয়।
অথচ আল্লাহ বলেন:

الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ
“পুরুষরা নারীদের অভিভাবক।”
(সূরা নিসা: ৩৪)
ফলে বিবাহ ও পরিবার-ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়।

(৪) যুবসমাজের ঈমান নষ্ট

অবাধ স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও নাস্তিকতা যুবদের ঈমান ও আমল নষ্ট করে।
আল্লাহ বলেন:

فَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ
“যেমন নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তুমি তেমনই অবিচল থাকো।”
(সূরা হুদ: ১১২)

কমিশনের নীতি মুসলিম যুবদের গাফেল ও বিভ্রান্ত করে।

(৫) নাস্তিকতা ও ধর্মদ্রোহ প্রসার

ধর্মত্যাগ, ধর্মবিদ্বেষ ও কুরআন-হাদীসের সমালোচনা সমাজে স্বাভাবিক হয়ে যায়।
অথচ রাসূল ﷺ বলেছেন:

«من بدل دينه فاقتلوه»
“যে তার দ্বীন পরিবর্তন করবে, তাকে হত্যা করো।”
(সহীহ বুখারি)
ইসলামবিরোধী প্রচারণা বাড়ে।

দ্বিতীয়ত: ইসলামী সমাধান ও করণীয়

(১) কুরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা

মানুষের প্রকৃত অধিকার হলো আল্লাহর দেয়া অধিকার।
আল্লাহ বলেন:

وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ
“আমি তো আদম সন্তানদেরকে সম্মানিত করেছি।”
(সূরা ইসরা: ৭০)

তাই শরীয়াহ মেনে অধিকার রক্ষা করতে হবে।

(২) ইসলামী শিক্ষা ও দাওয়াত প্রচার

যুবসমাজ ও নারীদের কুরআন-সুন্নাহ শিক্ষা দিয়ে সচেতন করা।
ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য তুলে ধরা।
রাসূল ﷺ বলেন:

«بلغوا عني ولو آية»
“আমার পক্ষ থেকে এক আয়াত হলেও পৌঁছে দাও।”
(সহীহ বুখারি)

(৩) শরীয়াহভিত্তিক আইন বাস্তবায়ন

রাষ্ট্র ও সমাজে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে আল্লাহর আইন অনুযায়ী।
আল্লাহ বলেন:

وَأَنِ احْكُم بَيْنَهُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ
“তুমি তাদের মধ্যে আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা অনুযায়ী বিচার করো।”
(সূরা মায়িদা: ৪৯)

(৪) মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সহযোগিতা জোরদার করা

বিভক্তি ও শত্রুতা পরিহার করে ইসলামী ঐক্য গড়ে তোলা।
আল্লাহ বলেন:

وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا
“তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধরো এবং বিভক্ত হয়ো না।”
(সূরা আলে ইমরান: ১০৩)