
✍️মাওলানা শেখ মিলাদ হোসাইন সিদ্দিকীঃ ★কুরআনে অর্থনৈতিক নির্দেশনা…
মানুষের জীবিকা ও অর্থনীতি সম্পর্কে একেবারে প্রাথমিক ও মৌলিক কথা হলা যে, মহান আল্লাহই মানুষের জীবিকা ও অর্থনীতির সমুদয় উপকরণ সৃষ্টি করেছেন, যার ফলে সেগুলোকে এমনভাবে এবং এমন প্রাকৃতিক বিধানের উপর সৃষ্টি করেছেন, যার ফলে সেগুলো মানুষের জন্যে উপকারী ও কল্যাণবহ হয়েছে। তিনিই মানুষকে এসব থেকে ফায়দা লাভের সুযোগ করে দিয়েছেন। তিনিই মানুষকে সেগুলো ব্যয় ব্যবহার করার ক্ষমতা দান করেছেন। এই প্রকৃত সত্যকথা ও মৌলিক তত্ত্বকে আল কুরআন অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেছে-
সূরা মুলক এর ১৫ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
هُوَ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ ذَلُولًا فَامْشُوا فِي مَنَاكِبِهَا وَكُلُوا مِنْ رِزْقِهِ وَإِلَيْهِ النُّشُورُ“
তিনিই যমীনকে তোমাদের জন্যে বাধ্যগত ও বশীভূত করে দিয়েছেন। অতএব তোমরা এর প্রশস্তহতার উপর চলাচল কর এবং আহার কর তাঁর প্রদত্ত জীবিকা থেকে। আর (জেনে রেখো) তোমাদের পুনরায় জীবিত হয়ে তাঁরই কাছে ফিরে যেতে হবে।”
এরপর সূরা আর রা’দ এর ৩ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَهُوَ الَّذِي مَدَّ الْأَرْضَ وَجَعَلَ فِيهَا رَوَاسِيَ وَأَنْهَارًا وَمِنْ كُلِّ الثَّمَرَاتِ جَعَلَ فِيهَا زَوْجَيْنِ اثْنَيْنِ“
আর তিনিই যমীনকে বিস্তৃত করে দিয়েছেন, তাতে পাহাড় বানিয়েছেন আর প্রবাহিত করে দিয়েছেন সমুদ্র ও নদ নদী। আর তিনি সৃষ্টি করেছেন সব ধরনের ফল ফলাদি দুই দুই প্রকার।”
এরপর সূরা বাকারার ২৯ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُمْ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا“
তিনি তোমাদের জন্যে সেই সবই সৃষ্টি করেছেন, যা পৃথিবীতে রয়েছে।”
এরপর সূরা ইব্রাহিম এর ৩২- ৩৪ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন –
اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَأَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجَ بِهِ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًا لَكُمْ وَسَخَّرَ لَكُمُ الْفُلْكَ لِتَجْرِيَ فِي الْبَحْرِ بِأَمْرِهِ وَسَخَّرَ لَكُمُ الْأَنْهَارَ وَسَخَّرَ لَكُمُ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ دَائِبَيْنِ وَسَخَّرَ لَكُمُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ وَآتَاكُمْ مِنْ كُلِّ مَا سَأَلْتُمُوهُ وَإِنْ تَعُدُّوا نِعْمَتَ اللَّهِ لَا تُحْصُوهَا إِنَّ الْإِنْسَانَ لَظَلُومٌ كَفَّارٌ“
তিনিই আল্লাহ, যিনি আকামণ্ডল সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন পৃথিবী, আর আকাশ থেকে বর্ষণ করেছেন পানি। অতপর এরই সাহায্যে তোমাদের জীবিকার জন্যে সৃষ্টি করেছেন নানারকম ফলফলাদি। নৌযানকে তিনি তোমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন করেছেন, যাতে করে তাঁরই নির্দেশ তা সমুদ্রে চলাচল করে। তিনি সমুদ্রকেও তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছেন। তিনি সূর্য-চাঁদকেও তোমাদেরই কল্যাণার্থে একটি নিয়মের অধীনে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছেন, সেভাবেই তারা আবর্তিত হচ্ছে। আমি তোমাদের স্বার্থেই রাত দিনকে একটি বিধানেনর অধীন করে দিয়েছি। আর তোমরা যা কিছু চেয়েছো[“অর্থাৎ যা কিছুর তোমরা মুখাপেক্ষী এবং বর্তমানে তোমরা যা কিচু চাও। অতীতের চাওয়া না চাওয়াতে কিছু যায় আসেনা,
সবই তোমাদের দিয়েছি। তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহরাজি গুণকে চাইলে গুণতে পারবেনা।”
এরপর সূরা ওয়াকিয়া এর ৬৩-৬৪ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন-
أَفَرَأَيْتُمْ مَا تَحْرُثُونَ
أَأَنْتُمْ تَزْرَعُونَهُ أَمْ نَحْنُ الزَّارِعُونَ
তোমরা কি তোমাদের কৃষি খামারের ব্যাপারে চিন্তা করে দেখেছো? এই যে তোমরা বীজ বপন কর, তা থেকে (গাছ ও ফসল) তোমরা উৎপাদন কর, নাকি আমি?”।
★আল্লাহর-নির্ধারিত সীমার ভেতরে ব্যক্তিমালিকানার স্বীকৃতি…
কুরআন আল্লাহ তা’আলার সার্বভৌম মালিকানার অধীনে এবং তাঁর আরোপিত সীমারেখার ভেতরে ব্যক্তিমালিকানাকে স্বীকার করে।
সূরা নিসার ২৯ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন-
لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ إِلَّا أَنْ تَكُونَ تِجَارَةً عَنْ تَرَاضٍ مِنْكُمْ“
তোমরা অবৈধ পন্থায় একে অপরের অর্থসম্পদ ভোগ-ভক্ষণ করোনা। তবে পারস্পরিক সন্তুষ্টির ভিত্তিতে তোমাদের মাঝে লেনদেন ও ব্যবসা বাণিজ্য হতে পারে।”
এরপর সূরা বাকারা ২৭৫-২৭৯ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا“
আল্লাহ ব্যবসাকে বৈধ করেছেন আর অবৈধ করে দিয়েছেন সুদকে।”
”وَإِنْ تُبْتُمْ فَلَكُمْ رُءُوسُ أَمْوَالِكُمْ“
তোমরা যদি সুদ নেয়া য়েতে ফিরে আস তওবা কর তবে নিজেদের মূলধন ফেরত নেবার অধিকার তোমাদের রয়েছে।
★অর্থসম্পদ উপার্জনে হারাম হালাল বিবেচনা করা…
অর্থসম্পদ শুধুমাত্র বৈধ পন্থায় অর্জন করতে হবে, আর অবৈধ পন্থা সম্পূর্ণরূপে বর্জন করতে হবে,
সূরা নিসার ২৯ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ إِلَّا أَنْ تَكُونَ تِجَارَةً عَنْ تَرَاضٍ مِنْكُمْ وَلَا تَقْتُلُوا أَنْفُسَكُمْ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا “
হে লোকেরা, যারা ঈমান এনেছো! তোমরা নিজেদের মধ্যে অন্যায়াবে একে অপরের সম্পদ ভক্ষণ করোনা,
আর নিজেকে নিজে কিংবা পরস্পরকে তোমরা হত্যা করোনা,আল্লাহ অবশ্যি তোমাদের প্রতি কৃপাময়।”
★পরিশেষে বলবো…
পুঁজিবাদ ও কমিউনিজমের মধ্যবর্তী পর্যায়ে ইসলাম যে ভরসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক মতাদর্শ অবলম্বন করেছ তার ভিত্তিতে একটি কার্যকর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাগড়ে তোলার জন্য ইসলাম নৈতিক শক্তি ও আইন- এ উভয়ের সাহায্য নিয়েছে। নৈতিক শিক্ষার সাহায্য ইসলাম সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির মন মানসকে এ ব্যবস্থার স্বতস্ফূর্ত আনুগত্য করার জন্য তৈরী করে। অন্যদিকে আইনের বলে মানুষের উপর এমন সব বিধি নিষেধ আরোপ করে যার ফলে মানুষ এ ব্যবস্থার চৌহদ্দীর মধ্যে নিজেদেরকে আটকে রাখতে বাধ্য হয় এবং এর সুদৃঘ প্রাচীর ভেদ করে যেতে পারেনা। এ নৈতিক বিধি বিধান ও আইনসমূহ হচ্ছে ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূল স্তম্ভ। নৈতিকতা, আইন এবং ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রকৃতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করার জন্য এসবের বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন।