
মুফতি আলাউদ্দীন আল আজাদঃ জুমার নামাজ ফরজ- কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তায়ালা বলেন
يا ايها الذين امنوا اذا نودي للصلاه من يوم الجمعه فسعوا الى ذكر الله
হে ঈমানদারগণ! জুমার দিনে যখন তোমাদেরকে নামাজের জন্য আহ্বান করা হয় তখন আল্লাহর জিকিরের দিকে অগ্রসর হও। এই আয়াতে উল্লেখিত ذكر الله শব্দের ব্যাখ্যায় হজরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন خطبه الامام والصلاه معه ইমামের খুতবা এবং তার সাথে নামাজ আদায় করা হলো ذكر الله বা আল্লাহর জিকির। এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা জুমার দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সাথে সাথে রসুল স. ও এ নির্দেশ পালনের তাগিদ দিয়েছেন যা দ্বারা ফরয প্রমাণিত হয়।
عن ابني عمر انا حفصه زوج النبي صلى الله عليه وسلم ان النبي صلى الله عليه وسلم قال رواح الجمعه واجب على كل محترم
রসূলুল্লাহ স. এর স্ত্রী হজরত হাফসা রা. বলেন রসুলুল্লাহ স. ইরশাদ করেন প্রত্যেক সাবালক পুরুষের জন্য দ্বিপ্রহারে জুমার দিকে রওনা করা ওয়াজিব।(নাসাঈ ১৩৭৪)
হাদীসটির স্তর-সহি। জামিউল উসুলের তাহকীকে শাইখ আব্দুল কাদের আরনাউত রহ. বলেন واسناده صحيح হাদীসটির সনদ সহি। কোরআন হাদিসের ফরজ এবং ওয়াজিব একই অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যদিও ফিকহে হানাফিতে দুই শব্দের মধ্যে পারিভাষিক ব্যবধান করা হয়। হাদিসের শব্দ থেকে কোরআনের উক্ত নির্দেশের দৃঢ়তা ও আবশ্যকতার সমর্থন মিলে। সব মিলে এটা প্রমাণিত হয় যে জুমার নামাজ ফরজ। এটাই হানাফী মাযহাবের মত।(শামী-১/১৩৬)
জুমার নামাজের ওয়াক্ত-
عن اناس بن مالك رضي الله تعالى عنه ان النبي صلى الله عليه وسلم كان يصلي الجمعه حين تميل الشمس
হজরত আনাস ইবনে মালেক রা.বলেন রসূলুল্লাহ স. সূর্য ঢলে গেলে জুমার নামাজ আদায় করতেন। (বুখারী-৮৫৮) শাব্দিক কিছু তারতম্যসহ এ হাদিসটি আবু দাউদ এবং তিরমিজি শরীফে বর্ণিত হয়েছে।(জামিউল উসুল-৩৯৫৯)
এই হাদিস থেকে প্রমাণিত হয় যে পশ্চিম আকাশে সূর্য ঢ়লে যাওয়ার সাথে সাথেই জুমার নামাজের ওয়াক্ত হয়ে যায়।
জুমার নামাজের পূর্বে কমপক্ষে চার রাকাত নামাজ পড়া-عن ابي عبد الرحمن السلمي قال كان عبد الله يامرنا ان نصلي قبل الجمعه اربعه وبعدها اربعا حتى جاءنا علي فامرنا ان نصلي بعدها ركعتين ثم ربعنا
হজরত আব্দুর রহমান আসসুলামী রা.বলেন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ রা. আমাদেরকে জুমার আগে চার রাকাত এবং জুমার পরে চার রাকাত আদায় করার নির্দেশ দিতেন। আর হজরত আলী রা. এসে আমাদেরকে নির্দেশ দিলেন জুমার পরে প্রথমে দু’রাকাত অতঃপর চার রাকাত পড়তে।(আব্দুর রাজ্জাক-৫৫২৫/তাবরাণী-৯৪৩৬)
হাদিসটির স্তর-হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন এ হাদিসের রবিবার সকলেই নির্ভরযোগ্য (আদদিরায়াহ)
এ হাদিস থেকে প্রমাণিত হয় যে হজরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. জুমার পূর্বে চার রাকাত নামাজ পড়তেন। আর সাহাবায়ে কেরাম যে আমলের অনুসরণ করে থাকেন তা অবশ্যই রসূলুল্লাহ স. থেকে শুনে বা তাকে করতে দেখে করে থাকেন। এ কারণে মুহাদ্দিসিনে কিরাম ইবাদাত সংক্রান্ত বিষয়ে সাহাবায়ে কিরামের আমল বা মন্তব্য কে মারফু তথা রসূলুল্লাহ স. এর আমল বা মন্তব্য হিসেবে মেনে নিয়েছেন।
حدثنا حفص عن الاعمش عن ابراهيم قال كانوا يصلون قبلها اربعا
হজরত ইব্রাহিম নাখাঈ রহ বলেন,তারা সাহাবায়ে কিরাম জুমার পূর্বে চার রাকাত আদায় করতেন।(ইবনে আবি শাইবা-৫৪০৫)
বুখারী শরীফের বিশিষ্ট ব্যাখ্যাকার আল্লামা ইবনে রজব হাম্বলী রহ ইবনে আবিদ দুনিয়ার লিখিত “কিতাবুল ঈদাইন” এর বরাতে এ হাদীসটিকে সহি বলেছেন।(ফাতহুল বারী ৮/৩৩০)
জুমার ওয়াক্তের শুরুতে ও খুতবার পূর্বে আযান দেওয়া:- হজরত সায়েব ইবনে ইয়াজিদ রা. বলেন রসূলুল্লাহ স. আবু বকর ও ওমর এর জমানায় জুমার দিনের প্রথম আজান ইমাম মেম্বারের উপর বসলে দেয়া হতো। অতপর ওসমান এর সময় লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে তিনি জুমার দিন দ্বিতীয় আযানের নির্দেশ দেন। তখন যাওরা নামক স্থানে এ আযান দেওয়া হতো। অথপর এটাই বহাল থাকে।(বুখারী-৮৭০)
খুতবা দাঁড়িয়ে দেওয়া এবং দুই খুতবার মাঝে বৈঠক করা সুন্নত-
عن جابر ابن سمره رضي الله عنه قال كانت للنبي صلى الله عليه وسلم خطبتان يجلس بينهما يقرا القران ويذكر الناس
হজরত জাবের ইবনে সামুরা রা.বলেন রসূল স. এর খুতবা হতো দুটি। দুই খুতবার মাঝে তিনি বসতেন। খুতবায় কোরআন পাঠ করতেন এবং মানুষদের উপদেশ দিতেন।(মুসলিম ১৮৬৮) শাব্দিক কিছু তারতম্য সহ এই হাদিসটি আবু দাউদ নাসাঈ এবং ইবনে মাজা শরীফে বর্ণিত হয়েছে (জামিউল উসুল-৩৯৬৭)
খুতবা আরবি ভাষায় দোয়া-
يا ايها الذين امنوا اذا نودي للصلاه من يوم الجمعه فسعوا الى ذكر الله
হে ঈমানদারগণ! জুমার দিনে যখন তোমাদেরকে নামাজের জন্য আহ্বান করা হয় তখন তোমরা আল্লাহর জিকিরের দিকে অগ্রসর হও। (সূরা জুমা-৯)
এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, জুমার খুতবা মূলত আল্লাহর জিকির, শুধু বক্তব্য বা ভাষণ নয়। আর আল্লাহর জিকিরের মধ্যেও ভাষান্তর গ্রহণযোগ্য নয়। অনুরূপভাবে সাহাবায়ে কেরামের মধ্য অনেক অনারব সাহাবাও ছিলেন। কিন্তু তারা কখনো মাতৃভাষায় খুতবা দিয়েছেন এমন প্রমাণ মেলে না। এটা খোলাফায়ে রাশেদা সহ সমগ্র উম্মতে মুসলিমার আমলী ইজমা। অতএব এর অনুকরণ করা একান্ত জরুরী। সুতরাং জুমার মূল আরবী খুতবা আরবি ভাষা ব্যতীত ভিন্ন কিছু হবে না। এটাই হানাফী মাযহাবের মত। (তাতারখানিয়া-২/৫৬২) অবশ্য মুসলিম উম্মাকে প্রয়োজনীয় নসিহতের জন্য খুতবার পূর্বে মাতৃভাষায় কিছু কথা বলা যেতে পারে সেটাও মেম্বারে না হয়ে ভিন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে বা ভিন্ন চিয়ারে বসে দেওয়া উত্তম হবে।
খুতবার সময় চুপ থেকে মনোযোগ দিয়ে শোনা-واذا قرا القران فاستمعوا له وانصتوا لعلكم ترحمون
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন যখন কোরআন পাঠ করা হয় তখন মনোযোগ সহকারে শ্রবণ কর এবং চুপ থাকো যাতে তোমাদের প্রতি রহমত বর্ষিত হয়। (আরাফ-২০৪) হজরত আব্দুল্লাহ বিন মাসুদ আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস আবু হোরায়রা আব্দুল্লাহ মুগাফফাল রা. বলেন এই আয়াত নামাজ ও খুতবা সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে।
জুমার পর চার রাকাত নামাজ পড়া সুন্নাত -عن ابي هريره قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من كان منكم مصليا بعد الجمعه فليصلي اربعا
হজরত আবু হোরায়রা রা. থেকে বর্ণিত রসুলুল্লাহ স. ইরশাদ করেন, তোমাদের কেউ যদি জুমার পর নামাজ আদায় করতে চায় তাহলে সে যেন চার রাকাত আদায় করে। (মুসলিম ১৯১১)
এই হাদিস থেকে প্রমাণিত হয় যে রসূল স. জুমার পরে চার রাকাত নামাজ পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন
লেখক:- মুফতি আলাউদ্দীন আল আজাদ, শ্যামনগরী।
খতিব-কোনাবাড়ী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, গাজীপুর।