আজ ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ ইং

পদ্মার এক বোয়ালের দাম ২৩ হাজার টাকা

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ঘাটের মাছ ব্যবসায়ী ১০ কেজি ৪শ গ্রাম ওজনের এক বোয়াল মাছ ক্রয় করেছেন ২২ হাজার ৮৮০ টাকায়। আজ বুধবার ভোরে মাছটি পদ্মা নদীর ১নং ছাত্তার মেম্বার পাড়া‍`র কলা বাগান এলাকা থেকে জেলে আয়জাল প্রামানিকের চায়না দুয়ারী জালে ধরা পরে।

দৌলতদিয়া ৫নং ফেরি ঘাটের মৎস্য ব্যবসায়ী সম্রাট শাহজাহান শেখ উপজেলার উজানচর ইউনিয়ন চর কর্ণেরশন জেলে আয়জাল প্রামাণিকের বাড়িতে যেয়ে দর দাম করে ২হাজার ২শ টাকা কেজি ধরে ২২ হাজার ৮৮০ টাকা দিয়ে মাছটি ক্রয় করেন। পরে সকাল ৯ টার দিকে তার নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ৫নং ফেরি ঘাটে শাকিল-সোহান মৎস্য আড়তে নিয়ে আসেন। এ সময় দৌলতদিয়া ৫নং ফেরি ঘাটের উৎসুক জনতা মাছটি এক নজর দেখার জন্য ভিড় জমান।

মৎস্য আড়তের মালিক ব‍্যবসায়ী শাহজাহান শেখ বলেন, সকালে মাছটি ক্রয় করে ৫নং ফেরি ঘাটের পন্টুনের সাথে রশি দিয়ে পদ্মা নদীর পানিতে বেঁধে রাখা হয়েছে। এখন দেশের বিভিন্ন জায়গায় মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হচ্ছে। কিছু লাভ পেলেই মাছটি বিক্রি করবেন।

রাজশাহী মহানগরীর আলুপট্টি ঘোষপাড়া বড় বটতলায় বসেছিলেন সত্তর বছর বয়সী ধীরেন কর্মকার। পাশেই তার বাড়ি। ধীরেনের সারাটা জীবন কেটেছে পদ্মাপাড়ে। পদ্মার সঙ্গেই ছিল তার বসবাস। পায়ের কাছটা দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘এখানে একসময় পদ্মার উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়ত। সে কী গর্জন! উত্তাল ঢেউ! বর্ষার সময় পদ্মার গর্জনে ঘুমানোই যেত না। ভয় লাগত। কোথায় হারিয়ে গেল সেসব! কী ছিল, কী হয়ে গেল! এখন পদ্মা দেখলে মনে হয় মরুভূমি। পানি দেখাই যায় না। কোন দূরে চলে গেছে। এখানে বসলে এখন দেখা যায় শুধু ধু-ধু বালুচর।’

পদ্মার বর্তমান রূপ দেখে আক্ষেপের শেষ নেই ধীরেনের মতোই নদীপাড়ের অসংখ্য মানুষের। তাদের কাছে পদ্মা এখন অচেনা এক ছোট নদী। একদা পানির তোড়ের কারণেই পদ্মার আরেক নাম ছিল ‘সর্বনাশা’। জেলেদের জালে ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ত ইলিশ। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর ছিল। পদ্মার পানিতে চলত দুপাড়ের কৃষি সেচ। পদ্মার রূপ নিয়ে রচিত হয়েছে গান, কবিতা, উপন্যাস। সেই পদ্মা এখন পানির স্বাভাবিক প্রবাহ না থাকায় নিজস্ব রূপ হারিয়েছে। নেই জেলেদের নৌকার সারি। বিলীন হয়ে গেছে জলজ প্রাণিকূল। নানা প্রজাতির মাছ নেই। নাব্যতা না থাকায় পারাপারের নৌকাও চলে না ঠিকমতো। তাই ওপারের বিস্তীর্ণ চর মাড়িয়ে তারপর খানিকটা পথ নৌকায় চড়ে এপারে শহরে আসতে হয় চরের মানুষকে।

রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ভূ-তত্ত্ব গবেষক অধ্যাপক ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, বিগত চার দশকে পলিমাটি আর বালুতে পদ্মার বুক ভরাট হয়ে গেছে অন্তত ২০ মিটার পুরু হয়ে। পানির প্রবাহ না থাকলে পলি অপসারণ হবে না। এখন বর্ষাকালেই পদ্মায় দু’কূল ছাপানো ঢেউ আর চোখে পড়ে না। আর খরা মৌসুমে পদ্মার বুক যেন তপ্ত মরুভূমি হয়ে ওঠে। প্রবাহ ফেরাতে না পারলে অচিরেই অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলতে পারে পদ্মা।

সম্প্রতি পদ্মায় মাছ কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে একটি দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। এতে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় এবং যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার একদল গবেষক অংশ নেন। তাদের গবেষণায় উঠে এসেছে, ১৯৮৪ সালের তুলনায় শুকনো মৌসুমে পদ্মা নদীর আয়তন কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। পানির গভীরতা কমেছে ১৭.৮ শতাংশ। প্রবাহ কমেছে ২৬.২ শতাংশ। আর মিঠাপানির সরবরাহ সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।

গবেষক দল দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণা পরিচালনা করেছেন। ‘বায়োডাইভারসিটি অ্যান্ড কনজারভেশন’ নামে নেদারল্যান্ডস থেকে প্রকাশিত একটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী গত বছর জানুয়ারি সংখ্যায় তাদের গবেষণার ফল প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, পদ্মা অববাহিকায় বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১৯.২ শতাংশ কমেছে। ১৯৮১ সালে যেখানে তাপমাত্রা ছিল ২৫.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬.২ ডিগ্রিতে। মূলত পদ্মার প্রকৃত অবস্থা বুঝতেই গবেষণার জন্য শুকনো মৌসুমকে বেছে নেওয়া হয় বলে জানান গবেষকরা।

গবেষক দলের সমন্বয়ক ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শামস মুহা. গালিব আমাদের সময়কে বলেন, আমরা ১৯৮২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পদ্মার হাইড্রোলজিক্যাল, জলবায়ু ও নৃ-তাত্ত্বিক পরিবর্তনের সঙ্গে মৎস্য প্রজাতির সম্পর্কের প্রক্রিয়া অনুসন্ধান করছিলাম। স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবি নিয়েও আমরা বর্তমান পরিস্থিতির পার্থক্য বোঝার চেষ্টা করেছি। এটা করতে গিয়ে দেখা গেছে, পদ্মার আয়তন বর্তমানে অর্ধেক কমে গেছে। এর প্রভাবে পদ্মার পুরো জীববৈচিত্র্যে প্রভাব পড়েছে। পানির জোগান না থাকায় পদ্মা থেকে মাছসহ প্রাণিবৈচিত্র্য বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। চর ডোবে না। আরও চর জাগছে। পদ্মায় পানি সরবরাহ কমে গেছে। ফলে পানির রিজার্ভ অর্ধেকে নেমেছে। গড় গভীরতা কমেছে।

পালি জমাট বেঁধেছে।

রাজশাহীর গোদাগাড়ী থেকে চারঘাটের সারদা পর্যন্ত পদ্মার ৭০ কিলোমিটার অংশ নিয়ে গবেষণাটি পরিচালিত হয়। ওই এলাকার নয়টি পয়েন্টে মৎস্য প্রজাতির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পদ্মাপাড়ের ২৭টি জেলেপল্লী থেকে নেওয়া হয় তথ্য।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের পশ্চিম সীমান্ত থেকে ১৮ কিলোমিটার উজানে গঙ্গা নদীতে দেওয়া হয়েছে বাঁধ, যা ফারাক্কা বাঁধ নামে পরিচিত। ১৯৬১ সালে বাঁধের মূল নির্মাণকাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে। ভাটি অঞ্চলে হওয়ায় উজানের যে কোনো ধরনের পানি নিয়ন্ত্রণের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বাংলাদেশে। ফলে নাব্যতা হারিয়েছে পদ্মা নদী, উত্তাল রূপ এখন ধূসর বালিয়াড়ি। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত পদ্মায় প্রতি সেকেন্ডে পানি প্রবাহ ছিল ৩ লাখ ১৮ হাজার ৬৪৮ কিউসেক। ফারাক্কা বাঁধ চালুর পর প্রবাহ নেমেছে এক লাখ ৮১ হাজার ৫৫০ কিউসেকে। ১৯৯৬ সালে করা ভারত-বাংলাদেশ ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি অনুযায়ী, ফারাক্কা পয়েন্টে ৭০ হাজার কিউসেক পানি থাকলে উভয় দেশ পাবে ৩৫ হাজার কিউসেক। ৭০ থেকে ৭৫ হাজার কিউসেক পানি থাকলে বাংলাদেশ পাবে ৩৫ হাজার, অবশিষ্ট পাবে ভারত। তবে ৭৫ হাজার কিউসেকের বেশি পানি থাকলে ভারত পাবে ৪০ হাজার কিউসেক, অবশিষ্ট পাবে বাংলাদেশ। চুক্তি থাকলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন বলছেন বিশ্লেষকরা।

এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. শীতাংশু কুমার পাল বলেন, প্রকৃতির ক্ষতি করলে প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নেবে। বর্তমানে সেটাই ঘটছে। পদ্মায় পানির প্রবাহ না থাকায় বালুর স্তূপ জমেছে। তীব্র রোদে তেতে উঠে লু হাওয়া হয়ে জনবসতিতে আঘাত হানছে।

 

Comments are closed.

     এই বিভাগের আরও সংবাদ